সূচিপত্র
রুমি এক কিংবদন্তী নাম। যাঁর সম্মানিত পুরো নাম মওলানা জালালুদ্দিন রোমি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন পারসিয়ান দরবেশ-কবি। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, দ্যা ফাইনেস্ট পোয়েট ইন পারসিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ অব অল টাইম—অ্যান্ড প্রোবেবলি দ্যা গ্রেটেস্ট সুফি মিস্টিক।
তাঁর কবি-সত্তা ও দরবেশি জিন্দেগিকে যেমন আলাদা করে দেখা যায়—তেমনি তাঁর কাব্যিক চেতনা ও সুফিচিন্তার সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে লেজেন্ডারি রুমি চরিত্রের। এ যেন এক নিবেদিত মহা-প্রেমিক যাঁর মন ও প্রাণের প্রতিটা বিন্দু থেকে নিবেদন করা হয়েছে কবিতার একেকটি স্তবক। রুমির সুফি-চরিত্র ছিল তাঁর নিজস্ব জীবনদর্শন দ্বারা প্রভাবিত। সেদিক থেকে তাঁর মহান দার্শনিক ব্যক্তিত্বও প্রস্ফুটিত।
তিনি ছিলেন স্পষ্ট দর্শনের মানুষ। একজন থিওলোজিয়ান এবং একজন জুরিস্ট। তাঁর হাজার হাজার কবিতা এরকমই এক বায়োগ্রাফি বয়ান করে। কবিতা ও কর্মে তিনি মানুষের আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছেন, কবিতায় বলেছেন কীভাবে জীবনকে নিজের চোখে দেখতে হয় ও এক্সপেরিয়েন্স করতে হয়। তাঁর কবিতা মুসলিম সুফিবাদী ধর্মচিন্তাকে যেমন প্রভাবিত করেছে—জানিয়েছে ঐকান্তিক এক ঈশ্বর-প্রেমে বিলীন হবার কথা, পন্থা দেখিয়েছে, তেমনি ইসলামিক কালচার ও লিটেরেচারকে এনরিচ করেছে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির জীবনী
প্রশ্ন | উত্তর |
---|---|
নাম | জালাল উদ্দিন রুমি মুহাম্মদ বালখী |
কুনিয়ত | রুমি |
লকব | মৌলভি/ মাওলানা |
শায়েখ | দরবেশ শামস তাবরিজি |
পিতা | বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ |
মাতা | মুইমিনা খাতুন |
জন্ম | সেপ্টেম্বর ৩০, ১২০৭ খ্রি। |
মৃত্যু | ১২৭৩ খ্রি। |
স্ত্রি | গওহর খাতুন |
জন্ম ও বংশ পরিচয়
মওলানা রুমি সেপ্টেম্বর ৩০, ১২০৭ সালে বলখের খোরাসান প্রভিন্স–বর্তমান আফগানিস্তানে—জন্মগ্রহন করেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয় যে তার পিতা—বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ— বলখ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ওয়াখশ নামে একটি ছোট শহরে—আধুনিক তাজিকিস্তানে—বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন বলখের প্রসিদ্ধ সুফিবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ, ধর্মোপদেষ্টা, একজন শিক্ষক এবং লেখক। রুমির দাদা—হুসাইন ইবনে আহমাদ খাতিবি—ছিলেন বড়মাপের পণ্ডিত ও দরবেশ মানুষ।
তিনি খোয়ারিজমের সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মাদের একমাত্র কন্যা মালিকা-ই-জাহানকে বিয়ে করেছিলেন। যাঁর গর্ভে রুমির পিতা জন্ম নেন। এ বিয়ে সম্পর্কে একটি সুন্দর গল্প কথিত আছে যে, এ বিয়ের কথা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম স্বপ্নযোগে রুমির দাদা, সুলতান, শাহজাদি ও সুলতানের এক উজিরকে বলেছিলেন।
রুমির পিতা বাহাউদ্দিন তাঁর পিতার জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক খ্যাতি ধরে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী, তাই মানুষ তাঁকে সুলতানুল উলামা উপাধি দিয়েছিল। তিনি এতই জ্ঞানী ও ভালোমানুষ ছিলেন যে লোকে তাঁকে দ্বিতীয় আবু বকর বলেও ডাকত।
রুমি রহ. এর শৈশব
রুমির শৈশব কেটেছে সফরে সফরে। ইনফ্যান্সি থেকে তিনি পরিবারের সাথে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ট্রাভেল করতে করতে বড় হয়েছেন। তাঁর জন্মের কিছুদিন পরই তাঁর পরিবার আসন্ন মঙ্গোল ইনভ্যাশনের আশঙ্কায় খোরাসান ছেড়ে চলে যায় এবং প্রায় এক যুগ ধরে মধ্য-প্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে বসবাস করে। এ সফরের মধ্যেই ইরানের নিশাপুরে পারস্যের প্রসিদ্ধ কবি ফরিদুদ্দিন আত্তারের সাথে তাঁর দেখা হয়। তিনি যুবক রুমির দ্বারা চমৎকৃত হন এবং নিজের রচিত আসরারনামা কিতাবটি উপহার দেন । একটু পর যখন রুমি তাঁর পিতা বাহাউদ্দিনের সাথে চলে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি স্বগোক্তভাবে বলে ওঠেন—
‘একটি নদী পেছনে একটি বিশাল সমুদ্রকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।'
রুমির শৈশব ছিল চঞ্চল, বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌতূহলে ভরা। একটি ঘটনা এমন জানা যায় যে—একবার তাঁর এক খেলারসাথী তাকে প্রতিবেশীদের একটি ছাদে লাফ দেওয়ার প্রস্তাব করলে রোমিকে বলতে শোনা যায়— ‘শোনো ভাই, ছাদ থেকে ছাদে লাফিয়ে বেড়ানো তো বিড়ালদের মতো প্রাণীর জন্যেই শোভা পায়। যদি তোমার লাফাবার ইচ্ছেই হয়, তাহলে আসো আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে আসমানে উঠে যাই এবং আল্লার বেহেশত দেখে আসি।'
মঙ্গোল আগ্রাসন
১২১৭ সালে রুমির পরিবার খোরাসান থেকে বাগদাদে পৌঁছলে তারা সুফি শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ারদি কর্তৃক নিমন্ত্রিত হন এবং একমাসের মতো সময় সেখানে থাকেন। এসময় রুমির পিতা বাগদাদ খলিফার দেওয়া উপহার প্রত্যাখান করেন এই বলে যে, এসব অন্যায়ভাবে অর্জিত জনগনের সম্পদ—এবং—এমনকি খলিফার নিমন্ত্রণও তিনি উপেক্ষা করেন। কিন্তু বাগদাদের জামে মসজিদে খলিফার উপস্থিতিতে নামাজ পড়াবার আমন্ত্রণ গ্রহন করেন এবং জুমার খুতবায় খলিফাকে তাঁর অনৈতিক জীবনযাপনের জন্যে তিরস্কার করেন।
তিনি মঙ্গোলদের আক্রমণ সম্পর্কেও সতর্ক করেন। রুমির পরিবার বাগদাদে অবস্থানকালেই বলখে মঙ্গোলদের আক্রমণের খবর পাওয়া যায়। জানা যায় যে, বলখের প্রাচীন বিদ্যাপীঠটি ধ্বংস করে ফেলেছে হিংস্র অসভ্য বর্বরেরা।
বাগদাদ থেকে রুমির পরিবার হজের জন্যে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং পথে সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পো ভ্রমণ করে। এরপর তাঁরা ১২১৮ সালের শুরুতে ফোরাত নদীর উজানে পূর্ব আনাতোলিয়ার আকশাহর পৌঁছেন। সেখানে তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন দীর্ঘদিন একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন।
প্রায় চারবছর পর পরিবারটি আবার চলতে শুরু করে এবং সেন্ট্রাল আনাতোলিয়ার রোম (রোমান ল্যান্ড—যেখান থেকে রোম এবং রুমির উৎপত্তি হয়েছে।) প্রভিন্সের লারান্দায় (কারামান) পৌঁছে এবং সেখানে সাত বছর অবস্থান করে। এইখানে তাঁর পিতা আমির মুসা নামক এক লোকাল গভর্নরের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতে থাকেন। এইখানে তাঁর মা ও বড় ভাই মৃত্যুবরণ করেন।
রুমি ১৭ বছর বয়সে গওহার খাতুনকে বিয়ে করেন। রুমির পরপর দুটি ছেলে-সন্তান জন্ম নেয় যাদের একজনের নাম রাখেন আলাউদ্দিন—রুমির সদ্য মৃত বড়ভাইয়ের নামে, আরেকজনের নাম সুলতান ওয়ালাদ—তাঁর দাদার সম্মানে।
লারান্দায় থাকাকালীন রুমির পিতা বাহাউদ্দিন সেলজুক শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদের তরফ থেকে একটি আমন্ত্রণ পান যাতে তিনি কোনিয়ায় শিক্ষকতার প্রস্তাব গ্রহন করেন। ১২২৯ সালে তাঁরা কোনিয়ায় চলে আসেন যখন রুমির বয়স ২২ বছর—এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এসময় রুমির পিতা তাঁকে একজন ধর্মোপদেষ্টা হিসেবে মানুষের ভেতর পরিচয় করিয়ে দিয়ে ধর্মীয় প্রচারের সুযোগ করে দিলে ধর্ম-প্রচারকের জীবন শুরু হয় রুমির। বাহাউদ্দিন ৮২ বছর বয়সে তার বছর দুই পর ১২৩১ সালে ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা রুমির শিক্ষা-দীক্ষা
বাহাউদ্দিন তাঁর নিজের ছাত্র ও বিশ্বস্ত শিষ্য বুরহানুদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইনফ্যান্সির সময়টাতে রুমির শিক্ষা-দীক্ষার। রুমির পিতার এন্তেকালের বছরখানেক পর বুরহানুদ্দিন কোনিয়ায় আসেন এবং গুরুর মৃত্যুর কথা জানতে পারেন। উনিশ বছর আগের মক্তব-গুরু এবার রুমির আধ্যাত্মিক শিক্ষকতার দায়িত্ব নেন। রুমি নয় বছর ধরে বুরহানুদ্দিনের কাছে আধ্যাত্মিকতার সবক নেন। যাকে স্মরণ করে রুমি লেখেন— ‘পরিণত হও, ক্ষান্ত দাও মনবদলের ধারা হয়ে ওঠো বুরহানের মতো চিরন্তন আলোকবর্তিকা যখন তুমি নিজের থেকে পালিয়ে যাও—নিজেরই প্রামাণ্য হয়ে ওঠো।
যখন তুমি বলো “আমি দাস”—মনে রাখবে, তখন তুমিই শাহেনশাহ হয়ে যাও।” বুরহানুদ্দিন রোমিকে সিরিয়ার আলেপ্পোতে পাঠান পড়াশোনার জন্যে। সেখানে তিনি হানাফি মাযহাবের একটি ইসলামি আইন বিষয়ক মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। এরপর তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় উচ্চতর পড়াশোনার জন্যে। এই দুইটি শহর ছিলো ত্রয়োদশ শতাব্দীর উন্নত দুইটি জ্ঞানকেন্দ্র যেগুলো মঙ্গোলদের ইনভ্যাশন থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছিলো।
সিরিয়াতে অবস্থানকালে রুমি চিরাচরিত ধর্মীয় জ্ঞান যেমন— ফিকহ, তাফসীর, হাদিস, থিওলোজি এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নেন। সিরিয়ায় সাত বছর কাটাবার পর রুমি কাইসেরিতে (বর্তমান তুরস্কের) ফিরে আসেন এবং প্র্যাক্টিজিং সুফিবাদের পাঠ নেন। এসময় তিনি নিজ পিতা হযরত বাহাউদ্দিনের বিভিন্ন লেখা—যেমন আধ্যাত্মিক জার্নালস ও নোটবুকস এবং তার অনূদিত কুরআনের তাফসীর ইত্যাদি গভীরভাবে পাঠ করতে থাকেন। এরপর রুমির গুরু বুরহানুদ্দিন তাকে একটি সুফিদলের সাথে পুনরায় কোনিয়ায় পাঠান সেখানকার বিভ্রান্ত মানুশগুলোকে ধর্মের পথে আনার মিশনে।
আল্লামা রুমির কর্মজীবন
তার কিছুদিন পর ১২৪১ সালে গুরু বুরহানুদ্দিন মারা যান এবং মরবার আগে এভাবেই তিনি তার উপর গুরু বাহাউদ্দিনের আরোপিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে রোমিকে পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে দিয়ে যান। কোনিয়াতে রুমি তাঁর পিতার সেই পুরনো মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ব্যাপকভাবে মানুশের ভেতর ধর্মীয় আইন, বোধ-চিন্তা, চর্চা ও অনুরাগ ছড়িয়ে দিতে থাকেন। জীবন-দর্শন ও নৈতিক মূল্যবোধের পাঠ। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে রুমি সর্বজন স্বীকৃত বিশাল একজন স্কলারে পরিণত হন—যেমন ছিলেন তাঁর পিতা হযরত বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ। তিনি জীবনের বিশাল একটা অংশ আল্লামা শামসুদ্দিন তাবরিজির সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেন এবং তাবরিজির মৃত্যুর মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করলেন। তার পরবর্তীসময়গুলো তিনি শিক্ষকতা ও আল্লার প্রেমে মশগুল হয়ে কাটিয়ে দিতে লাগলেন।
শামসুদ্দিন তাবরিজির সান্নিধ্য (শামস তাবরিজি)
নভেম্বর ২৯, ১২৪৪ সালের এক বেলায়—রুমি কোনিয়ার বাজারের ভেতর দিয়ে মাদরাসা থেকে ঘরে ফিরছিলেন। পথে একজন দরবেশের সাথে তাঁর দেখা হয়। দরবেশের নাম শামসুদ্দিন তাবরিজি। শামসুদ্দিন তাবরিজির সাথে তার সাক্ষাত রুমির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তীতে। এই ঘটনা তার জীবন, দর্শন ও চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন নিয়ে আসে। শামসুদ্দিন ছিলেন খাপছাড়া স্বাধীন চিন্তার একজন দরবেশ। তার গভীর মিস্টিক চরিত্র রোমিকে প্রভাবিত করে এবং পথের দেখা থেকেই একে অপরের বন্ধু ও আধ্যাত্মিক সঙ্গী হয়ে পরেন। শামসুদ্দিন তাবরিজির সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে রুমি লিখেছেন—
‘আমি একটি স্বপ্ন দেখি যে আমাকে বলা হচ্ছে—“আমরা তোমাকে একজন দরবেশের সঙ্গী বানাব।” আমি জিজ্ঞেস করলাম—“কোথায় এই দরবেশ?” পরের রাতে আমাকে স্বপ্ন বলা হলো যে—“সে আনাতোলিয়ায় (রোম) আছে।”
কিছুক্ষণ পরে আবার স্বপ্নে দেখলাম যে আমাকে বলা হচ্ছে—“এখনো সময় হয়নি। সবকিছু তার সময় হলেই পূর্ণতা লাভ করে।”” শামসুদ্দিন তাবরিজির সাথে তাঁর সাক্ষাতের ঘটনাটা এরকম পাওয়া যায়— একদিন শামসুদ্দিন একটি সরাইয়ের প্রবেশদ্বারে বসে ছিলেন। এমন সময় পায়দলে চলতে থাকা ছাত্র-শিষ্যে পরিবিষ্ট রুমি একটি খচ্চরে চড়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। শামসুদ্দিন উঠে দাঁড়ান, এগিয়ে যান এবং রুমির সওয়ারির রশি ধরে জিজ্ঞেস করেন—
‘প্রভুর নাম জানা হে গভীর অর্থের অনুধাবক, আমাকে বলুন—কে শ্রেষ্ঠতম, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাকি বায়েজিদ বোস্তামী?” ‘অবশ্যই অতুলনীয়ভাবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! তিনি সকল নবী ও সুফির চেয়ে শ্রেষ্ঠ।'—রুমি জবাব দেন। তখন শামসুদ্দিন পুনরায় বলতে থাকেন—‘তা কী করে হয়! মুহাম্মাদ বলেছেন—“ও আল্লা, আমরা তোমাকে জানার মতো করে জানতে পারিনি।” অথচ বায়েজিদ বলেছেন—“আমিই গৌরব! আমার গৌরব কতই-না উত্তম!””
এ কথা শুনে রুমি বেহুঁশ হয়ে পড়েন এবং হুঁশ ফেরার পর শামসুদ্দিনকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। এর পরের ঘটনা খুব সুন্দর ও মজার। রুমি শামসুদ্দিনকে তাঁর প্রশ্নের জবাব দেন এই কথা বলে যে—
‘বায়েজিদের তৃষ্ণা তো এক চুমুকেই মিটে গিয়েছিল। অথচ মুহাম্মাদের তৃষ্ণা যে তাঁর প্রার্থনার সাথে সাথে বেড়েই চলেছিল – হে বন্ধু!'
একথা শোনার পর শামসুদ্দিন বেহুঁশ হয়ে পড়েন।
শামসুদ্দিনের সান্নিধ্যে রুমি এতটাই মশগুল হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি তাঁর অনুরাগী ছাত্র-শিষ্যদের প্রতি খানিকটা বেখেয়াল হয়ে পড়েছিলেন। এতে তাঁরা শামসুদ্দিনের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং এমনকি শামসুদ্দিনকে গোপনে হুমকি-ধামকি দিতে থাকেন। এজন্যেই অথবা অন্য কোনো কারণে একদিন হঠাৎ করেই তিনি কিছু না জানিয়েই গোপনে কোনিয়া ত্যাগ করেন এবং সিরিয়ায় চলে যান। রুমি এতে আহত হন। পরবর্তীতে রুমি তাঁর অবস্থান জানতে পারেন এবং কোনিয়ায় ফিরে আসবার অনুরোধ জানিয়ে তাঁকে চিঠি লেখতে থাকেন। কিন্তু তিনি আসতে অস্বীকার করেন।
পরবর্তীতে রুমি তাঁর ছেলেকে দামেস্কে পাঠান শামসুদ্দিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে এবং এবার তিনি বন্ধুর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে কোনিয়ায় ফিরে আসেন। রুমি তাঁর প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদযাপন করেন। তার কিছুদিন পর ১২৪৭ সালে রুমি কিমিয়া নাম্নী একটি মেয়ের সাথে বন্ধুর বিয়ে দেন—বাট, আনফরচুনেটলি, শী ডিড নট লিভ লং। বছরখানেক পরই শামসুদ্দিনের সঙ্গিনী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। শামসের জীবন একটি বাগান হলে সেখানে তার উপস্থিতি কেমন যেন—সে একটি বাগানের মধ্যে দিয়ে অল্প একটু পায়চারি করে চলে গেলেন অনন্ত দূরে।
দরবেশ শামসুদ্দিন হয়তো সঙ্গিনী হারাবার বিরহে কাতর হয়ে–বা পূর্বের মতোই কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে একবার বললেন যে—তিনি আবারও হাওয়ায় হারিয়ে যাবেন এবং এবার তাঁর চিহ্নও কেউ আর খুঁজে পাবে না। ১২৪৭ বা ১২৪৮-এর শুরুতে তিনি নাই হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁকে মার্ডার করা হয়েছিলো। ঘটনাটা এমন—
মওলানা রুমি ও শামস বসে বসে আলাপ করছিলেন। এমন সময় দরজায় নক করে কেউ। জানানো হয় যে, একজন দরবেশ অনেকদূর থেকে সফর করে এসেছেন এবং শামসুদ্দিন দরবেশের সাথে দেখা করতে চান। শামস তাঁর ঘর থেকে বের হন এবং হারিয়ে যান। তাঁকে আর কখনো দেখা যায়নি। বলা হয় যে, তিনি বের হলে তাঁকে একদল খুনি আক্রমণ করে এবং আঘাত করতে করতে হত্যা করে ফেলে। রুমি ঘর থেকে তাঁর বন্ধু শামসের ব্যথার চিৎকার শুনতে পান—কিন্তু ঘটনাস্থলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে খুনিরা তাঁর মৃতদেহ দূরে অন্ধকারের ভেতর গোপন করে ফেলে।
কিন্তু অধিকাংশ গবেষক ও পণ্ডিতেরা এই হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করেন। কারণ, মওলানা রুমি পরবর্তীতে দুইবার করে শামসুদ্দিনকে খুঁজতে নিজের কাছের শিষ্যদের নিয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন এবং দুইবারই তাঁকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শামসুদ্দিনকে হারিয়ে মওলানা রুমি বেশ দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এই ঘটনাও মওলানার জীবনকে আরেকবার প্রভাবিত করে। তিনি বন্ধু হারাবার শোকে বিরহে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকেন কিছুদিন। এত খোঁজার পরও তাঁকে না পেয়ে শেষে তিনি
বললেন—
“আমিই তো সে— তবে আর খুঁজে ফিরছি কাকে, কীসের জন্যে
আমিই তার প্রতিচ্ছবি—নিজের সাথেই আমি কথা বলছি না কেন।'
সবকিছুরই প্রতিকার হয়, সবকিছুই কিউর হয়ে যায় সময়ের সাথে। রোমিও শোক সেরে উঠলেন একসময়। তিনি পুনরায় মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করলেন। তার পরবর্তীসময়গুলো তিনি শিক্ষকতা ও আল্লার প্রেমে মশগুল হয়ে কাটিয়ে দিতে লাগলেন।
শামসুদ্দিন দরবেশের সাথে সাক্ষাৎ সান্নিধ্য তাঁর অন্তরকে আল্লার প্রেমে পূর্ণ করে দিয়েছিলো। তার ভেতর থেকে বের করে এনেছিল দরবেশ যিন্দেগীর অনুপ্রেরণা। রুমি মনে করতেন, শামসুদ্দিন দরবেশের সাথে পরিচয়ের পরই তাঁর সত্যিকারের কবিতা শুরু হয়েছিল। শামসকে নিয়ে তিনি পরবর্তীতে প্রচুর কবিতা লিখেছিলেন। বন্ধুকে হারানোর কষ্ট তাই তিনি সারিয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
আল্লামা রুমির মৃত্যু
১২৭৩ সালের শরতে রুমি অসুস্থ হন। সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান ও তাঁর উজির-নাজিররা তাঁকে দেখতে আসেন। তাঁর শিয়রে দিনরাতের জন্যে দুইজন ফিজিশিয়ান নিযুক্ত করা হয়। তাঁরা তাঁকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতেন। রুমির মৃত্যুর চল্লিশদিন পূর্বে কোনিয়ায় ভূমিকম্প হয়। লোকেরা তাঁর কাছে জড়ো হয়ে ভীতি প্রকাশ করে এবং দুআ চায়, তিনি তাদের সাহস দেন। তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে তিনি বলে দেন যে মৃত্যু জীবনেরই অংশ। মৃত্যু সেপারেশন না— মৃত্যু যে লিবারেশন— তিনি তাদের জানান। তিনি আবৃত্তি করেন
‘মরলে কেঁদো না বন্ধু; আমার সমাধিতে—গেয়ো না বিচ্ছেদের গান
আমার জন্যে এ তো মহানন্দময় মিলনের ক্ষণ আমার কবর-যাত্রায় বন্ধু বলো না বিদায়— আত্মার শান্তির জন্যে একটু শুধু পর্দা টেনে নিলাম।' ডিসেম্বর ১৭, ১২৭৩ সালের সন্ধ্যায় কাঙ্ক্ষিত মিলনের উদ্দেশ্যে কবি ও দরবেশ রুমি পরকালযাত্রা করেন
জালাল উদ্দিন রুমির বিখ্যাত বইগুলো
- মসনবী শরীদি
- ওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজি
- ফীহি মা ফীহি
- মাকাতিব
- মাজালিস-ই-সাব
মুদ্দা কথা; আমাদের কি করা উচিত।
মওলানা জালালুদ্দিন রোমি—বা, সিমপ্লি রোমি—বিস্তর পাঠের একটি চরিত্র। দরবেশ রুমি ও কবি রোমিকে আলাদাভাবে পাঠেরও সুযোগ আছে। পৃথক পাঠ হওয়া দরকারও।
এই লেখায় তার জীবনের একটা ফ্লো দেখানো হয়েছে বলা যায়—তাও কত সংক্ষিপ্তাকারে। ব্যাপারটা এমন যেন রুমির বায়োগ্রাফির উপর দিয়ে হাওয়ার মতো একবার উড়ে যাওয়া হয়েছে। কখনো দ্রুতই, কখনো ধীরে। কখনো বেশকিছু পার্শ্ব-গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে তার চারপাশটা জানতে ও অনুধাবন করতে। একটি চরিত্রের চরিত্রে তার কন্ট্রিবিউশন দেখার চেয়েও তার ব্যক্তিজীবন দেখাটা জরুরী।
এখানে মূলত সেটিই করা হয়েছে। রুমির এমনই এক বায়োগ্রাফি যে তা লিখতে গেলে ফিকশন হয়ে ওঠে। পাঠ করলেই তার ব্যক্তিজীবন পাঠের গুরুত্ব টের পাওয়া যায়।
রোমিকে নিয়ে আরো রিসার্চ হওয়া দরকার। অমুসলিম গবেষকদের মাধ্যমে রুমি ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। রুমির কবিতার অনুবাদের বই বেস্টসেলার হচ্ছে। কিন্তু এদের গবেষণায় রুমির চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে বলা যায়। রোমিকে নিয়ে প্রোপার গবেষণাটা হওয়া দরকার তাই। হয়তো হয়েছে কিছু, কিন্তু সামনে আসছে কোলম্যান বার্কসদের কাজ। তাতে রুমি চরিত্রের ক্ষতিসাধন হয়েছে ব্যাপক।
ওসব দেশে রুমির বই বেস্টসেলার হয়েছে, আমাদের দেশে তার কবিতা কেবল আংশিকভাবে ফার্সি শেখার কাজে সিলেবাস ও ওয়াজ-নসিহতের শের হয়েছে, কিন্তু কবিতা পাঠের নিয়তে কম মানুশই নিয়মিত পড়েছে। নামহীন ও নন-ফিকশনাল একাডেমিক প্রকাশনা নির্ভর কিছু প্রকাশনী থেকে নিম্নতম মানের কাগজে প্রকাশ হয়েছে কিছু বই, যার প্রচ্ছদ দেখলেই পাবলিক কেনার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছে। ভালো কোনো অনুবাদও হয়নি বলা যায়।
মোটকথা,আমাদের দেশে রুমি এখনো প্রচার হয়নি, বিচিন্ন খাতিরে অন্তত যতটা হওয়া উচিত ছিলো; যেমন হয়েছে কিটস, শেক্সপিওর, পো, গ্যাটে ও অন্যান্যরা। এদের কে যেভাবে পাঠ করা হয়, রোমিকে অতোটা ট্র্যাডিশনালি পাঠ করা হয় না। এখানে কি জনরা বা ঘরানা বলতে কোনো ব্যাপার কাজ করছে? রুমির কাব্য-বিস্তৃতি কি এতটা সীমাবদ্ধ? আশা করি রোমিকে নিয়ে ভালো কিছু কাজ হবে আমাদের দেশে। মওলানা রোমিকে আল্লা মাগফিরাত দিন। তাঁর প্রেমের মর্যাদা দি
Rate This Article
Thanks for reading: মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। Maulana Jalaluddin Rumi । জালালুদ্দিন ও শামস তাবরিজি । Alfamito Blog , Sorry, my English is bad:)