যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর জীবনী। Alfamito Blog

হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর জীবনী, Alfamito Blog
Alfamito Blog
সূচিপত্র

যায়েদ ইবনে হারেসা রাযিআল্লাহু তা'আলা আনহু যিনি ছিলেন মহন সাহাবী তিনি ক্রীতদাস থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্রের মর্যাদা অর্জন করেন তিনি তার সাহসিকতা বীরত্বে অনেক বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনিই একমাত্র সাহাবি যার নাম কুরআন শরীফে এসেছে।

যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর জীবনী

যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর জীবনী

প্রশ্ন উত্তর
নাম আবু উসামা যায়িদ
গোত্র কুজায়া
উপাধি হিব্বু রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
পিতা হারেস বিন শুরাহবীল
মাতা সু’দা বিনতু সা’লাবা
জন্ম ৫৮১ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ
সন্তান রুকাইয়া বিনতে যায়েদ, উসামা ইবনে যায়েদ,

যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর পিতা মাতা ও বংশ পরিচয় 

লোহিত সাগরের পাড়ে... লোহিত সাগরের তীরঘেঁষা দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন অঞ্চল। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের মরুভূমির ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। বরং এখানের মৃত্তিকা স্বর্ণপ্রসবিনী। তাই এই অঞ্চল অ্যারাবিয়া ফেলিক্স নামে বিখ্যাত। সাগর-উপকূলে মানুষের প্রধান পেশা কৃষি আর ব্যবসা বাণিজ্য। 

এখানেই বাস করে কুজায়া গোত্র। তাদের গোত্রপ্রধান হারেসা বিন শুরাহবীল। তার ছোট্ট সংসার। স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে ছোট্ট পরিবার। ছেলেটির নাম যায়েদ। বয়স মাত্র আট বছর। কিন্তু চতুরতায় সে পরিণত যুবককেও হার মানায়। তাই বাবা-মার কাছে ও সবচে আদুরে। তাদের মায়া ও মমতার ছায়ায় ছায়ায় দিনে দিনে বেড়ে উঠছিল সে। 

ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই... (কাফেলা লুণ্ঠন)

শিশু যায়েদের মন আজ অনেক উৎফুল্ল। গ্রামে যাওয়ার আনন্দে। নানাবাড়ি যাওয়ার খুশিতে। মা সুদা বিনতে সালাবার সাথে। তিনি বিখ্যাত তাঈ গোত্রের কন্যা। এটা যায়েদের সবচে আপন জায়গা। যেখানে সে সবার আদর একাই পায়। এখানে সে উড়ে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। ঘুরে বেড়ায় বনবাদাড়ে আর ঝোপঝাড়ে।

আজ সেই মাতুলালয় যাবে যায়েদ। তাই তার আর তর সইছে না। ইচ্ছে করছে উড়াল দিতে নিঃসীম নীলিমায়। 

অজানা বিপদ...

সোনা রোদ্দুর দুপুরে মায়ের হাত ধরে ইয়েমেনি কাফেলার সাথে তারা নানাবাড়ির পথ ধরল। পথের দূরত্ব যতই কমে, ততই তার মন নেচে ওঠে। 

এইতো আর একটু.. এরপরেই নানাবাড়ি।  কত আনন্দ! কত হাসি! কত দুরন্তপনা! কত দুষ্টুমি! কত আদর! কত ভালোবাসা! 

তাদের কাফেলা এখন গন্তব্যের কাছাকাছি। তারা চলছে কায়েস গোত্রের লোকালয়-লাগোয়া মেঠোপথ দিয়ে। অনতিদূরেই তাঈ গোত্র। কাফেলার গন্তব্য। কিন্তু আকস্মিক সাক্ষাৎ-যম হয়ে দেখা দিল বিপদ। তাদের দিকে তেড়ে আসল কায়েস গোত্রের লোকেরা। লুটপাট করে সবকিছু ছিনিয়ে নিল। 

লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তারা। তখুনি সর্দারের চোখ পড়ে যায়েদের দিকে। যায়েদ ছিল হৃষ্টপুষ্ট। ওর ডাগর ডাগর চোখ আর মায়াবী চাহনিতে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ফুটে উঠত। সর্দারের মনে হল, তাকে বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তাই ছুটে এল সর্দার। হ্যাঁচকা টান দিয়ে যায়েদকে নামিয়ে আনল উটের পিঠ থেকে। ছেলের বিপদ দেখে দৌড়ে এল মা। সর্দারের পায়ে পড়লেন! হাতজোড় করে করুণা ভিক্ষা চাইলেন! কিন্তু অসভ্য বর্বর মানুষগুলোর মনে দয়া হল না! মায়া জাগল না! তারা যায়েদকে কেড়ে নিল মায়ের কোল থেকে। 

খোকা তুই আসবি কবে? মন যে আর মানে নারে!..

যায়েদের মায়ের কোল এখন শূন্য। একমাত্র সন্তান হারানোর বেদনা তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। তার মাতৃহৃদয় সন্তানের বিরহে খা খা করছে। অসহ্য যন্ত্রণা এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। 

যায়েদের বাবার অবস্থাও একই। যায়েদ ছিল তার আদরের সন্তান।যায়েদের কথাবার্তা, চলাফেরা সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করত। এই ছোট্ট বয়সেই যায়েদের বুদ্ধির প্রখরতা ও মেধার তীক্ষ্ণতা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই যায়েদের প্রতি তিনি ছিলেন অনেক দুর্বল। যায়েদকে হারানোর বেদনা তার কাছে ছিল পাহাড়সম!

যে বেদনা তিনি প্রকাশ করেছিলেন কবিতার ছন্দে- 

         بكيت على زيد ولم أدر ما فعل! أحي فيرجى أم أتى دونه الأجل!

             تذكرنيه الشمس عند طلوعها! وتعرض ذكراه إذا غربها أفل!

সে কি বেঁচে আছে না মৃত্যু তাকে করেছে আলিঙ্গন? 

আমি তো তার অপেক্ষায় বসে বসে গুনি ক্ষণ!

দিন কেটে দুপুর শেষে এসেছে সন্ধ্যা লগন, 

জানিনা এই জীবনে তার দেখা পাব কখন!

(যায়েদের বিরহে আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু নামে শ্রাবণধারায়!

আমি জানি না, সে কি বেঁচে আছে? আমি তো পথ চেয়ে আছি!

না কি মৃত্যু তাকে করেছে আলিঙ্গন!

সোনা রোদ সকালে সূর্য আমায় তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়!

বিষণ্ন বিকেলে অস্তাচলে রবির বিদায়বেলায় তার স্মৃতি মনে পড়ে যায়!) 

ফিরে পেলেন হারানো মানিক

দস্যুরা যায়েদকে নিয়ে গেল উকাজের বাজারে। ভালো দামে বিকাবে বলে। সেদিন মেলায় এসেছিলেন অভিজাত কুরাইশ বংশের ধনবতি, ভাগ্যবতী নারী, মহীয়সী খাদিজার ভাতিজা হাকাম বিন হিযাম। গোলাম কেনার উদ্দেশ্যে। ফুফুকে উপহার দিবেন তাই। 

যায়েদকে দেখে তার পছন্দ হল। কিনে নিয়ে আপন ফুফুকে উপহার হিসেবে দিলেন। ফুফু আবার এটা হাদিয়া দিলেন স্বামী মুহাম্মাদকে। এখন যায়েদ আরবের সবচে বিশ্বস্ত ব্যক্তি আল আমিনের কাছে। যায়েদ এখন মুহাম্মাদ ও খাদিজার স্নেহাদরে প্রায় ভুলতে বসেছে মা-বাবার কথা। তাঁরা তাকে সন্তানের মতো মনে করে। কখনও তারা তাকে মা-বাবার হারানোর কষ্ট বুঝতে দেননি। এমনকি সে কোনদিন মা-বাবার অভাবও অনুভব করেনি। 

সে যুগের মক্কা ছিল সবার প্রাণকেন্দ্র। কারণ মক্কায় রয়েছে কাবা শরীফ ও বাইতুল্লাহ। তাই এখানে সবদেশের মানুষেরই ছিল আনাগোনা। একবার খুযাআ গোত্রের কিছু লোক আসলো কাবার তাওয়াফে। তাদের চোখ পড়ল যায়েদের দিকে। তারা তাকে চিনতে পারল। তাদের একজন বলে উঠল, আরে এ আমাদের সর্দারের ছেলে না? সাথীরা জবাব দিল, হ্যা তাইতো, আমরা তাহলে ফিরে গিয়ে সরদারকে খবর দেব। 

আজ থেকে সে আমার পুত্র

কাফেলা ইয়েমেনে ফিরে গেল। তারা গোত্রপতিকে তার সন্তানের কথা জানাল। সব শুনে যায়েদের বাবা হারেসা সহোদর ভাই কাবকে নিয়ে ছুটে এলেন মক্কায়। তারা বুঝতে পারলেন যায়েদ এখন কারো অধীনস্থ গোলাম। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, যায়েদ এখন আরবের কুরাইশ বংশের আদর্শ যুবক মুহাম্মদের ক্রীতদাস। 

তারা মুহাম্মদের গৃহে আসলেন। বললেন, হে আল্লাহর ঘরের পড়শী! আপনারা তো বন্দীকে মুক্ত করেন। ক্ষুধার্তকে আহার দেন। মজলুমকে সাহায্য করেন। আপনাদের নিকট আমার ছোট ছেলেটি রয়েছে, আমি তাকে নিয়ে যেতে চাই। বিনিময়ে আপনি যত মূল্য চান, আমি দিতে রাজি।

জবাবে মুহাম্মদ বললেন, আমার কাছে ভালো মনে হয়, আমি যায়েদকে ইচ্ছাধিকার দেই-  যদি সে আপনার সাথে যেতে চায়, তবে বিনিময় কিছু দিতে হবে না। আর যদি আমার কাছে থাকতে চায়, তবে কিভাবে আমি তাকে ফিরিয়ে দেই?

তাঁর কথা শুনে তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন। অকপটে বলে ফেললেন, আপনি তো ন্যায়পরায়ণতায় সুদূর সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন!

তারা যায়েদকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা তোমার অভিমত কী? 

যায়েদ কোন দ্বিধা সংশয় ছাড়াই উত্তর দিল, 

বাবা! আমি ফিরে যেতে চাই না। আমি তার কাছেই থাকতে চাই!

উত্তর শুনে বাবার চেহারার উজ্জ্বল আভায় বিষন্নতার ছায়া পড়ল! তিনি বললেন, তুমি বাবা-মার আদরে আদরে কাটানো স্বাধীন জীবনকে ফেলে দাসত্ব বরণ করে নিতে চাচ্ছো?

যায়েদ বলল, বাবা! তাঁর মাঝে ফুলের মত অনুপম কিছু গুণের সমাহার রয়েছে। তাই তাকে ছেড়ে আমি কখনই যেতে পারব না! 

যায়েদের উত্তর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন মুহাম্মাদ। তিনি যায়েদকে নিয়ে কাবার চত্বরে কুরাইশদের জনসমাবেশে উপস্থিত হলেন এবং একটি পাথরের পিঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, 

এখন থেকে সে আর গোলাম নয় বরং সে মুক্ত এবং আজ থেকে সে আমার পুত্র!

মুহাম্মদের এই ঘোষণা শুনে যায়েদের বাবা-চাচা খুশি হলেন। তাদের মনে উঁকি দেয়া সংশয় কেটে গেল। তারা প্রশান্তচিত্তে ফিরে গেলেন বাড়িতে। 

যায়েদ ছিল তখন এক অবুঝ বালক। সে জানত না, নবী মুহাম্মদকে অগ্রাধিকার দিয়ে, সে কী গনিমত লাভ করেছে! সে স্বপ্নেও ভাবেনি, এ ব্যক্তির মাধ্যমেই দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হবে আসমানি সাম্রাজ্য!

তার কল্পনার ত্রিসীমায়ও আসেনি, তিনি হবেন একদিন গোটা বিশ্বের রাজাধিরাজ! 

এ ঘটনার কয়েক বছর পরেই মুহাম্মাদ লাভ করেন নবুওতের মর্যাদা। হেরা পর্বতের নাযিল হয় মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। তখন এই যায়েদই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং তিনি ছিলেন রাসূলের গোপন বিষয়ের ব্যাপারে আস্থাভাজন। যুদ্ধে রাসুলের পছন্দের সেনাপতি। ও রাসুলের অনুপস্থিতে মদীনার খলিফাদের একজন। 


যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)

যায়েদের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা

এরপর থেকেই লোকেরা যায়েদকে 'ইবনে মুহাম্মদ' বলে ডাকত এবং যায়েদের প্রতি রাসূলের ভালোবাসাও অনেক বেড়ে যায়। তিনি তার অনুপস্থিতিতে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। যায়েদ ফিরে আসলে আনন্দেরা যেন রাসুলকে জড়িয়ে ধরত।

একদিনের ঘটনা। আয়েশা রা. বলেন, যখন যায়েদ হিজরত করে মদিনায় এলেন এবং আমাদের দরজার কড়া নাড়লেন। তখন রাসূল দৌড়ে গেলেন। অথচ তিনি উদোম গায়। তিনি তার সাথে কোলাকুলি করলেন এবং তাকে চুমু দিলেন।

যায়েদের প্রতি রাসূলের এরূপ ভালোবাসার কারণেই অনেকে তাকে 'ভালোবাসার যায়েদ' বলে ডাকত। আবার কেউ কেউ 'মাহবুবে রাসূল' বলে ডাকত। 

বিদায় প্রিয়, আর দেখা হবে না (ইন্তেকাল)

অষ্টম হিজরী। মক্কা বিজয় হল। দিকে দিকে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ আসল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারেসা বিন উমাইর আযদীকে দিয়ে বসরার শাসকের কাছে ইসলামের দাওয়াতপত্র পাঠালেন। পথিমধ্যে জর্দানের পূর্বে মূতা নামক স্থানে গাসসানি শাসক শুরাহবীল বিন আমর তাকে বন্দী করে তাঁর শিরোশ্ছেদ করেন। 

সংবাদ শুনে রাসূল জিহাদের ঘোষণা দিলেন। হযরত যায়েদ বিন হারেসা রা.কে সেনাপতি নিযুক্ত করে জিহাদের কাফেলা প্রস্তুত করলেন। তিন হাজার মুজাহিদ সাহাবায়ে কেরাম রওনা করলেন মূতার পানে। জর্দানের পূর্বে মাআন নামক স্থানে তাঁরা তাঁবু স্থাপন করলেন। 

অন্যদিকে গাসসানি শাসক এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে অদূরেই সেনাশিবির স্থাপন করলেন। রোমসম্রাট হিরাক্লিয়াস আরো এক লক্ষ সেনা পাঠাল তার সহযোগিতায়। 

মূতার প্রান্তরে উভয় দলে তুমুল লড়াই চলল। তিন হাজার মুসলিম বাহিনী দুই লাখ কাফের সৈন্যকে ধুলোয় উড়িয়ে দিল। যুদ্ধে যায়েদ বিন হারেসা রা. বীরত্বের সাথে লড়ে গেলেন। কাফেরদের শতশত তীরের আঘাতে তাঁর শরীর তখন ঝাঁঝরা। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। শাহাদাতের লাল বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন। রক্তের স্রোতে ভাসতে ভাসতে। বিজয়ের হাসি হাসতে হাসতে। 

যুদ্ধের পর রাসূল তাঁর শাহাদাতের কথা শুনে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। তখন সাদ বিন উবাদা রা. জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি? রাসূল বললেন, এটা প্রিয়জন হারানোর বেদনার অশ্রু!

Rate This Article

Thanks for reading: যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) এর জীবনী। Alfamito Blog , Sorry, my English is bad:)

Getting Info...

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.